নাস্তিকতা : আমার অজ্ঞানবাদী দৃষ্টিতে

বলে রাখি, নাস্তিকতা খণ্ডাতে বসিনি। নাস্তিকবাদিদের কিছু যুক্তি ঠিক যৌক্তিক মনে হয় নি আমার কাছে। তা শুধু শেয়ার করছি মাত্র। যদি উগ্র নাস্তিকবাদি হয়ে থাকেন, সমালোচনা সহ্য করার ক্ষমতা না থাকে, যুক্তিনির্ভর অ্যাকাডেমিক আলোচনার চাইতে তর্কের খাতিরে তর্ক ও গালিগালাজ করতে বেশি সচ্ছন্দ বোধ করেন, তাদের জন্য আমার এ লেখা নয়। দ্বিতীয়ত, আস্তিকতা প্রমাণ করতেও বসিনি। আপনার যদি মনে হয়, আমার লেখা পড়ে আপনার এরকম মনে হচ্ছে, বুঝব, অতিমাত্রার অযৌক্তিক নাস্তিক্যবাদি/আস্তিক্যবাদি ‘বিশ্বাসের’ কারণে নিরপেক্ষ সমালোচনা বা ক্রিটিকাল থিঙ্কিং করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছেন। সেক্ষেত্রেও পড়া ক্ষান্ত দিতে পারেন।
১ম
নাস্তিকতার সহজ ও প্রথম যুক্তিটি হচ্ছে ‘ঈশ্বরের প্রমাণ পায়নি তাই বিশ্বাস করি না’।
কথাটি আমার কাছে খুব যৌক্তিক মনে হয় নি। ঈশ্বরের প্রমাণ পান নি কিসের মাধ্যমে? অবশ্যই যারা বলেন তারা বোঝান চোখে দেখার মাধ্যমে। মূলত যারা বলেন, তারা ঈশ্বরের সংজ্ঞাটি ভুল বুঝেছেন বলে আমি মনে করি। যদি ঈশ্বর থেকেই থাকেন, তাহলে তাঁর নির্মিত জগতে তাঁকে দেখতে চাওটা অযৌক্তিক। আপনি তাঁকে যে কৌশল বা ফিজিক্সের মাধ্যমে তাঁকে দেখতে চাচ্ছেন, সেই কৌশল তাঁরই তৈরি, ‘সংজ্ঞা’ অনুসারে। আপনি তাঁকে ছোট, বড়, প্রাকৃত, অতিপ্রাকৃত যে ভৌত আকার, আকৃতিতে দেখতে চান না কেন তাঁর সৃষ্ট (সংজ্ঞা অনুসারে) সময় পরিবেষ্টিত ত্রিমাত্রিক ভৌত কাঠামোতে তাঁকে দেখতে পারাটা প্রমাণ করে তিনি ঈশ্বর নন বা এই জগত তাঁর সৃষ্টি নয়। তাঁর চাক্ষুষ উপস্থিতি প্রমাণ করে উনি এই সৃষ্ট জগতের অন্তর্ভুক্ত। যদি এখন বলেন, এজন্যই আপনি বিশ্বাস করেন না ‘এই জগত ঈশ্বরের সৃষ্টি’ সেক্ষেত্রে আপনার ‘ঈশ্বরের প্রমাণ পান নাই বলে বিশ্বাস করেন না’ যুক্তিটি বা ‘ঈশ্বরের চাক্ষুষ প্রমাণ আশা করা’ অযৌক্তিক। আর ঈশ্বরের সঠিক সংজ্ঞা বুঝে থাকলে ঈশ্বরের চাক্ষুষ প্রমাণ আশা করা অযৌক্তিক তো বটেই।
অর্থাৎ ঈশ্বরের প্রমাণ নাই একথার পরিবর্তে একজন প্রশ্নকারী হিশেবে আপনি যদি প্রশ্ন রাখেন এই জগত ঈশ্বরের সৃষ্টি কি না? সেটিই হবে অধিক যুক্তিযুক্ত।
(পুনশ্চ : ঈশ্বর আছে কি নেই একবারও বলি নি। যে যুক্তির মাধ্যমে ঈশ্বরের অনস্তিত্ব প্রমাণ করতে চাইছেন, তা ধোপে টেকে না, তাই বলতে চেয়েছি।)
২য়
নাস্তিকতার সপক্ষে আর একটি বড় যুক্তি হচ্ছে, ঈশ্বরের নিষ্ক্রিয়তা পৃথিবীর সব অনাচার ও অবিচারের প্রতি। আমার মতে অতিরিক্ত আস্তিকতা থেকে বা আস্তিকতার অতিরিক্ততা বা আস্তিকতা চর্চার আকাশ কুসুম অযৌক্তিক আশা থেকে এই ধরনের মনোভাবের সৃষ্টি। পৃথিবীতে যত অনাচার তাঁর সমস্ত কিছুর সমাধানের দায়িত্ব ঈশ্বরের এবং এসব অনাচার ঈশ্বর বসে বসে দেখছেন এধরনের চিন্তা থেকেই এই যুক্তির উদ্ভব। তাই ঈশ্বরের অনস্তিত্ব সহজভাবে আমাদের এই সমস্যার সমাধান দেয় এভাবে, যে ঈশ্বর বলে কিছু নেই, এবং যত আনাচার তার সমাধান মানুষের হাতেই সম্ভব। মজার বিষয় উপসংহার ঠিক থাকলেও এই উপসংহারে পৌছনোর পদ্ধতির শুরুতে ফাঁকা রয়েছে। আপনি যদি প্রথমেই নাস্তিক হন তাহলে ঈশ্বর সমস্যা সমাধান করবে আশা করা অযৌক্তিক। আর যদি আস্তিক হন তাহলেও আপনার/আমাদের (মানব সম্প্রদায়ের) তৈরি করা অনাচার অন্য কেউ এসে সমাধান করে দেবে সে ঈশ্বরই হোক বা যেই হোক তা আশা করা যেমন অযৌক্তিক তেমনি অবিচার। সুতরাং নাস্তিক যৌক্তিকতা থেকে এধরনের উপসংহারে পৌছনো কখনই সম্ভব নয়। এক হতে পারে আপনি বুদ্ধি বিকৃত অতি আস্তিক; যার ফল আপনার এই অযৌক্তিক নাস্তিকতা (আপনার নাস্তিকতা অযৌক্তিক নয়, এই পদ্ধতিতে চিন্তার ফলে ঈশ্বরের অনস্তিত্বে আপনার অবিশ্বাস অযৌক্তিক) অথবা আপনি সক্রিয় ভাবে পৃথিবীর অনাচার অপসারণে নিজের অংশগ্রহণের প্রতি অমনোযোগী এবং অলস। অর্থাৎ পৃথিবীতে সৃষ্ট অনাচার অবিচার যে মানুষেরই সৃষ্ট এবং এর নিরসনের দায়িত্ব যে মানুষেরই এই উপলব্ধিতা নাস্তিক্যবাদি যুক্তির ভেতর দিয়ে আসা অপ্রয়োজনীয় এবং অনর্থক।
কিন্তু এই উপলব্ধিতা অত সহজে আসেনা বলেই হয়ত একই কারণে সমসাময়িক নাস্তিকবাদিরা নিজেদের হিউমানেটেরিয়ান নাস্তিক বা মানবতাবাদী নাস্তিক বলতে ভালবাসেন। কিন্তু এতেও রয়ে যায় আর এক ফাঁকি। মানবতাবাদী বলতে আসলে কি বোঝানো হয়? পৃথিবীতে যত বড় বড় কলঙ্কময় ঘটনা, হত্যাযজ্ঞ, আনাচার, অবিচার গুলো ঘটেছে সব হয়েছে মানুষের হাত দিয়েই। আবার যত মহান আত্মত্যাগ, সত্যের প্রতিষ্ঠা তাও হয়েছে মানুষের হাত দিয়েই। কেন আত্মত্যাগ ও মহান কাজ গুলোকে কে মানবতাবাদী কাজ বলব এবং মানুষের দ্বারাই সৃষ্ট অন্যায় কাজ গুলোকে মানবতাবাদী কাজ বলব না? খোলাসা করে বলি। নাস্তিকবাদি যুক্তিতে এগুলে প্রথমেই আসে যে, ঈশ্বর নেই। সেক্ষেত্রে মানুষই যুগে যুগে ঈশ্বর বা ঈশ্বরের ধারনা সৃষ্টি করেছে। সেই বিশ্বাসকে অপব্যবহার করে কিছু মানুষ বা কিছু গোষ্ঠীর মানুষ নিজের স্বার্থ হাসিল করেছে, ধর্মের নামে অনাচার করেছে। তাই যদি ঠিক হয়, মানবতাবাদী ও নাস্তিক একসাথে যায় না। কারণ যে মানুষ (আপনি, আমি আমরা সবাই) যুগে যুগে এই কাজ করেছে, আপনি সেই মানবতাবাদী বা মানবধর্মের জয়গান গেয়ে প্রকৃত পক্ষে কার পক্ষ নিচ্ছেন বা কি বোঝাতে চাচ্ছেন, বোধগম্য নয়। আমি কিন্তু বলছিনা, নাস্তিক কখনো মানবতাবাদী হতে পারবে না। বলছি নাস্তিকতায় ভাল, খারাপ নির্ণয়ের উৎস হিশেবে যখন মানবতাবাদকে বোঝান হয় তখন তা আসলেই প্রশ্নের সম্মুখীন। ভাল, খারাপের মধ্যে পার্থক্য বোঝার জন্য ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাসের প্রয়োজন নেই, একথা চরম ভাবে সত্য। কিন্তু মানুষের ভাল দিক গুলো বলতেই মানবতাকে বুঝব, এই উপলব্ধিতা মানুষ নিজে থেকেই তৈরি করেছে একথাও মেনে নেয়া কষ্টকর। কথাটা অদ্ভুত শোনালেও সত্যি। কারন কারন ভাল খারাপ নির্ণয়ের পদ্ধতি যদি মানুষেরই সৃষ্টি হত তাহলে, এই পদ্ধতি মানুষের পক্ষে ধ্বংস করা বা এই পদ্ধতিকে এর সৃষ্টির শুরুতে নিয়ে যাওয়া বা উল্টো সৃষ্টি করা সম্ভব হত যা কখনই সম্ভব নয়। সম্ভব হলে মানুষ ধর্মের নামে অনাচার সৃষ্টির আগে নৈতিক পদ্ধতির উল্টো ঘটিয়ে নিজের স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা করত সব কিছুর আগে সন্দেহ নেই।
(পুনশ্চ : নৈতিক পদ্ধতির উল্টো সৃষ্টির অর্থ, এমন এক পদ্ধতি সৃষ্টি করা যেখানে যেমন মিথ্যা বলা ভাল, চুরি করা ঠিক, হত্যা ভাল এছাড়া যেসব কাজ স্বার্থ হাসিলের জন্য সাহায্যজনক, বা যেগুলো নীতি বানাবার ইচ্ছে হত সেগুলোই নীতি হত। কথাটা খুব অদ্ভুত শোনালেও নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে চিন্তা করলে বুঝবেন কি বোঝাতে চেয়েছি। কথাটা আপনার কাছে অদ্ভুত শোনাচ্ছে, কারণ এ ধরনের পদ্ধতি সৃষ্টি কখনই সম্ভব নয়। যা কখনই সম্ভব নয় তা এরকম অদ্ভুত শোনায়। সম্ভব হলে শোনাত না।)

Leave a Reply